…বুঝতে পারি, এই সময়ের মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদলে গিয়েছে। তারা এখন কোনও সামাজিক সম্পর্কের ধার ধারে না। তারা চায় বিত্ত, স্বাচ্ছন্দ্য। তাদের দর্শনে তাৎক্ষণিক লাভের মূল্য অপরিসীম! তাই জীবনটা তারা যতখানি সম্ভব উপভোগ করে নিতে চায়। পরিবর্তে তারা যে কী হারিয়ে ফেলছে, তা বুঝতেও পারে না।
উপমন্যু রায়
এমন ঘটনার ব্যাখ্যা আমার কাছে ছিল না। পরীক্ষাও কাছে চলে এসেছিল। তাই সমস্ত যন্ত্রণা মনের ভেতরে চেপে রেখে পড়াশোনায় মন দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কাজটা বেশ কঠিন ছিল। তবু করতে হয়েছিল। আমি সাধারণ পরিবারের ছেলে। পরীক্ষা খারাপ হলে শুধু আমার নয়, আমাদের পরিবারেরও ক্ষতি হয়ে যাবে।
এম এ শেষ করেই আমাকে একটা চাকরি পেতে হবে। যে ভাবেই হোক। আমাকে মুখ বুজে সমস্ত কষ্ট সহ্য করে বাবা লেখাপড়া করাচ্ছিলেন। আমি সে–সব ভালোই বুঝতে পারতাম। আমি যদি চাকরি পেয়ে সংসারের হাল ধরতে পারি, বাবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন। বিশ্রাম নেবেন। অবসর জীবন যাপন করবেন। পাড়ার চায়ের দোকানে চা খাবেন। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে একটু গল্পগুজব করবেন। সাধারণ মধ্যবিত্ত পুরুষের এ–টুকুই তো স্বপ্ন!
পরীক্ষা খুব একটা খারাপ হল না। পরীক্ষার পর চাকরির চেষ্টা শুরু করেছিলাম। পাশাপাশি চেষ্টা করছিলাম পুরনো সব কিছু ভুলে তোমার সঙ্গে সম্পর্কটা ফের স্বাভাবিক করে নিতে। কিন্তু পারিনি। তুমি মোবাইল নম্বর পাল্টে ফেলেছিলে। আর, ল্যান্ডলাইনে বাড়িতে ফোন করে বেশির ভাগ দিনই তোমাকে পেতাম না। হয় ফোন বেজে যেত, না হলে অন্য কেউ ধরতেন। বলতেন, ‘অনসূয়া নেই।’ কোথায় গিয়েছ, তা তাঁরা জানেন না।
আর, যেদিন পেতাম, তুমি আশ্চর্য রকম ঠান্ডা এবং সৌজন্যমূলক কথা বলতে আমার সঙ্গে। যেন আমার সঙ্গে তোমার বন্ধুত্বটা নেহাতই সামান্য একটা সহপাঠীর। তোমার এই শীতল ব্যবহার আমাকে আহত করত। ক্ষতবিক্ষত করত। আমি কত রকম ভাবে আবেগ নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতাম, কিন্তু তোমার কাছ থেকে সাড়া পেতাম না। তুমি যেন স্রেফ নিয়ম রক্ষার্থে অদ্ভুত সহজ গলায় আমার কথার জবাব দিতে। স্বভাবতই কথা বেশি এগোত না।
তখন তুমি আমায় বলেছিলে, তুমি নাকি মোবাইল ব্যবহার করছ না। এত আজেবাজে ফোন আসে, মোবাইল সঙ্গে রেখে তুমি বিরক্ত হয়ে গিয়েছ! তবে আমার মনে হয়েছিল, তুমি ঠিক বলছ না। অবশ্য তা নিয়ে তোমার সঙ্গে আমি কোনও বিতর্কে যাইনি।
তার পর একদিন দুম করে বাইরে চলে গেলে। শুনেছি দিল্লি। আর দেখা হয়নি।
তোমার চলে যাওয়ার ঘটনাটা আচমকাই ঘটেছিল। আমি খবরও পাইনি। খবরটা দিয়েছিল রঞ্জন। একদিন রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছিল। রাস্তায় চায়ের দোকান থেকে আমরা চা খেয়েছিলাম।
আমাদের আলোচনায় স্বাভাবিক ভাবেই উঠে এসেছিল তোমার কথা। আমার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ নেই জেনে অবাক হয়েছিল।
আমার আর তোমার বিশেষ বন্ধুত্বের ব্যাপারটা তাদের কারও অজানা ছিল না। যদিও ব্যাপারটা নিয়ে তারা কখনও তেমন ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। কারণ, প্রেম ঘটিত সম্পর্ক বলতে যা বোঝায়, তোমার আর আমার মধ্যে তেমন কোনও সম্পর্ক তো কখনও তৈরি হয়নি! তাই তাদের চোখে কখনও তা ধরা পড়েনি। তবে আমার আচরণে তারা হয়তো তোমার প্রতি দুর্বলতাটা বেশ বুঝতে পারত। এও বুঝতে পারত, তুমিও কখনও আমাকে এড়িয়ে যেতে না! আড্ডা দেওয়ার সময় এ নিয়ে তারা মুচকি হাসত কখনও কখনও।
সেদিন রঞ্জনই বলেছিল তোমার কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। কোথায় গিয়েছ তা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারেনি। তবে রূপমদা নাকি তাকে বলেছে, তুমি দিল্লি চলে গিয়েছ।
তোমার দিল্লি চলে যাওয়ার খবরটা যে আমাকে খুশি করেনি, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু আমার তো কিছু করার ছিল না। তুমি কোথায় যাবে, কেন যাবে, তা নিয়ন্ত্রণের তো কোনও ক্ষমতা বা অধিকার আমার নেই!
তার পরেই ঘটে গেল একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা। আমাদের পরিবার এবং আমিও সেই ঘটনার আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলাম। একদিন গাড়ি চাপা পড়ে আমার বাবা অসহায়ের মতো মরে গেলেন।
বাবার সেই আকস্মিক মৃত্যু তখন আমাকে হতবাক করে দিয়েছিল। আচমকাই গোটা দুনিয়াটা আমার কাছে ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল আমাদের পুরো পরিবারটাই। বাড়িতে দুই বোন এবং মা। একমাত্র ছেলে আমি। বেকার। অথচ আমার কাঁধে এসে পড়ল পুরো সংসারের দায়িত্ব।
কী ভাবে কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কেবল টিউশনি করে পুরো পরিবারকে টেনে নিয়ে যাওয়াটা খুব কঠিন হয়ে যায় আমার পক্ষে। আবার টিউশনি করে সেই দায়িত্ব সামলানো ছাড়া বিকল্প কোনও পথও আমার সামনে খোলা ছিল না। অবশ্য পরিচিত লোকদের বলে কয়ে টিউশনির সংখ্যা কিছুটা বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলাম। এরই মধ্যে সময় করে পড়াশোনাও করতাম। চাকরির পরীক্ষা দিতাম। যথারীতি ব্যর্থ হতাম।
এরই মধ্যে একদিন ছোট বোনকে আবিষ্কার করলাম সম্পূর্ণ নতুন রূপে। এক্সাইডের মোড়ে এক মধ্যবয়স্ক অবাঙালি পুরুষের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ভাবে তাকে গাড়িতে উঠতে দেখে মাথায় আগুন ধরে গেল। নিজের চোখকেই আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু বাস্তবকে অস্বীকারই বা করব কী ভাবে?
বাড়ি ফিরলে তার কাছে সরাসরি ঘটনাটা জানতে চাইলাম। সে অস্বীকার করল না। বরং অবাক হলাম তার সাহস দেখে। স্বাভাবিক এবং দৃঢ় কণ্ঠে সে জানাল, ওই পুরুষটি মারওয়াড়ি। পেশায় ব্যবসায়ী। বিবাহিত। তিন সন্তানের জনক। তবু, সে নাকি ওই ব্যবসায়ীকে পছন্দ করে!
ছোট বোনের স্পর্ধা বা বোকামো দেখে বিস্মিত হয়ে গেলাম। অনেক বোঝালাম। বুঝল না। বকলাম। ভয় পেল না। শেষে কঠিন কণ্ঠে সতর্ক করলাম। পাত্তা দিল না। বরং কয়েক দিনের মধ্যেই সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।
আজ বোন শরৎ বসু রোডে একটি অভিজাত ফ্ল্যাটে থাকে। মারওয়াড়ি পুরুষটি ওই ফ্ল্যাটটি তাকে থাকতে দিয়েছে। তবে সে তাকে বিয়ে করেনি। সেজন্য অবশ্য আমার বড় আদরের ছোট বোনটির কোনও দুঃখ নেই। কারণ, টাকাপয়সার দিক থেকে তার এখন কোনও অভাব নেই।
কিন্তু আমার ছোট বোনের এখন একটাই পরিচয়। সে ওই মারওয়াড়ি ব্যবসায়ীর রক্ষিতা!
বুঝতে পারি, এই সময়ের মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদলে গিয়েছে। তারা এখন কোনও সামাজিক সম্পর্কের ধার ধারে না। তারা চায় বিত্ত, স্বাচ্ছন্দ্য। তাদের দর্শনে তাৎক্ষণিক লাভের মূল্য অপরিসীম! তাই জীবনটা তারা যতখানি সম্ভব উপভোগ করে নিতে চায়। পরিবর্তে তারা যে কী হারিয়ে ফেলছে, তা বুঝতেও পারে না।
আমি ভাবি, যেদিন বুঝতে পারবে, সেদিন কি আর ফিরতে পারবে নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে? জানি না। তবে জানি, এই জীবন তাদের স্বাভাবিক জীবন নয়। এই জীবন কিছু সময়ের জন্য একটা নাটক মাত্র। যেখানে তারা অভিনয় করে চলেছে। কিন্তু অভিনয় করে তো গোটা জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যায় না! সম্ভব নয়।
বাবার মৃত্যুতে মা মানসিক দিক থেকে ভেঙে পড়েছিলেন। বোনের এই অদ্ভুত সিদ্ধান্ত তাঁকে আরও আঘাত দেয়। তবে কোনও যন্ত্রণাই তিনি প্রকাশ করতেন না। শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতেন। আমি অসহায়ের মতো দেখতাম।
এখানেই শেষ নয়। আমাকে নিয়ে জীবনের রসিকতার তখনও কিছু বাকি ছিল। হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না বলে আমার বড় বোন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। আর ফিরল না। থানা–পুলিশ করলাম। কোনও লাভ হল না। কোথায় গেল, কেন গেল, বেঁচে আছে কিনা, জানতে পারিনি আজও।
—না, এই আঘাতটা আর নিতে পারেননি আমার মা। মানসিক ভারসাম্য পুরোপুরি হারিয়ে ফেললেন তিনি। আচমকা হেসে উঠতেন। বেশ জোরেই তখন হাসতেন। কেন হাসতেন, তা হয়তো তিনি নিজেও জানতেন না। কখনও আবার হাত–পা ছড়িয়ে কাঁদতেন। কেন কাঁদতেন, তাও বলতেন না। আবার সময় বিশেষে গুম মেরে যেতেন। কোনও কথাই কারও সঙ্গে বলতেন না। শুধু আকাশের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। হয়তো সৃষ্টিকর্তার কাছে মনের যাবতীয় অভিমান নীরবে উগরে দিতেন।
ডাক্তার দেখালাম। কোনও লাভ হল না। দিন যত যেতে লাগল, তাঁর অসুস্থতা ততই বেড়ে চলল। শেষ পর্যন্ত তাঁকে সামলানোই দায় হয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হত। নিজের মাকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখাটা একটা ছেলের কাছে যে কত বড় যন্ত্রণার, তা কাউকে বোঝানো যাবে না! দাঁতে দাঁত চেপে সেই ভয়ঙ্কর কাজটিও আমাকে করতে হয়েছে!
মাঝে মাঝে ঈশ্বরের কথা ভেবে আমার খুব হাসি পেত। মনে হত, আর কত সহ্য করব? কী অপরাধ করেছি আমি? কেন এত শাস্তি ভোগ করতে হবে আমাকে? কেন? কেন? মাঝে মাঝে আঙুল তুলে মনে মনে ঈশ্বরকে বলতাম, যদি সত্যি তুমি কোথাও থেকে থাকো, তা হলে আমার সমস্ত আবেগ, বিবেক কেড়ে নাও। আমাকে পাথর করে দাও। তা হলে অন্তত এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে আমি মুক্তি পাই!
অবশেষে মাকে একটি মেন্টাল অ্যাসাইলামে ভর্তি করে দিতে হল। এখনও তিনি সেখানেই আছেন।
সত্যি কথা বলতে কী, এত মানসিক চাপ আমি আর নিতে পারছিলাম না। মাঝে মাঝে মনে হত আমিও হয়তো পাগল হয়ে যাব। কিন্তু হইনি। কেন হইনি, জানি না। আবার কখনও কখনও মনে হত, আত্মহত্যা করব। কিন্তু তা–ও পারিনি। হয়তো কাপুরুষ বলে! তুমি ঠিকই বলতে অনসূয়া, আমি সত্যিই কাপুরুষ! (ক্রমশ)